ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মো. শাহ রিয়াদ হোসেন। ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি দিবাগত রাত শাহ রিয়াদের জীবনে এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের নির্দেশে বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বারা রাতভর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
জানা গেছে, নির্যাতনের সময় ফজরের নামাজ মসজিদে আদায় করতে চাইলে যেতে দেয়নি রিয়াদকে। হলে নিজের রুমে নামাজ আদায়ের পর শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় ছাত্রলীগের নির্যাতন। সেদিন ভোরে শারীরিক নির্যাতনের জন্য বিচার না করে উল্টো হল থেকে বের করে দেন হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল বাছির। সহযোগিতা নেন তৎকালীন ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রাব্বানীর। অভিযোগ রয়েছে, ওই ঘটনায় প্রক্টর শাহ রিয়াদকে ধমক দেন। যদি তিনি নিজেকে শিবির পরিচয় দিয়ে মুচলেকা না দেয়, তবে ছাত্রলীগ কিছু করলে তার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় নিবে না বলে জানিয়ে দেন তিনি।
দুই বছর পর সেই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এখন হল ছাড়া। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী গত ৩ সেপ্টেম্বর শাহ রিয়াদ বিজয় একাত্তর হলে পুনরায় সিট পেয়েছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রক্টর, নতুন প্রাধ্যক্ষ। এ ঘটনার বিচার চেয়ে শাহ রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করবেন বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি একটি মামলা করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
সেদিনের ভয়ংকর স্মৃতিচারণ করে শাহরিয়াদ প্রতিবেদক কে বলেন, সেদিন রাতে আমাকে হলের রুম থেকে গেস্ট রুমে নিতে আমার বন্ধু মাহিম আসে। তারপর তার সঙ্গে হলের মিনি গেস্টরুমে ঢুকার সাথে সাথে ইউসুফ তুহিন (শাখা ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক ও টেলিভিশন ও ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র) আমার ফোনটা নিয়ে নেয়। ফোন নিয়ে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখে এবং নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। সেখানে আমাদের দুই-তিন জন ব্যাচমেট ছিল। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ নামের একজন জুনিয়রও ছিল।
শাহ রিয়াদ বলেন, একটু পরে বাবু (শাহনেওয়াজ বাবু শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র) আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘তোমার কোম্পানির কী অবস্থা? কার্যক্রম কেমন চলছে?’ আমি এই প্রশ্ন শোনে অবাক হয়ে যাই। পরে মাজেদ (মাজেদুর রহমান শাখা ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র) আমাকে বলে, ‘চলো আমার রুমে।’ তখন আমাকে ৪ তলায় তার রুমে নিয়ে যায়। রুমে যাওয়ার পথে সিঁড়ির পাশে কনস্ট্রাকশনের কাজের একটা পিভিসি পাইপ নেয়। রুমে ঢুকার পর তার রুমের সবাইকে বের করে দেয়। পরে বারান্দার পাশে আমাকে একটা খাটের উপর বসায়। বসানোর সাথে সাথে আমার ডান পায়ের উপর পাইপ দিয়ে আঘাত করে। পাইপটা ভেঙে যায়। এরপর তুহিন চড় থাপ্পড় শুরু করে। একই সময়ে মাহমুদকেও তারা মারধর করে। এরমধ্যে একজন ভিডিও করা শুরু করে। আমাদেরকে জোর জবরদস্তি করে স্বীকারোক্তি দিতে বলে যে, আমরা শিবির করি। ভিডিওতে কী বলেছিলাম আমার খেয়াল নেই। মাহমুদকে রুমে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আমার ব্যাচমেট সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নুরুল ইসলাম সাব্বিরকে আনে। ওকে সন্দেহ করে। আনার পর একটা থাপ্পড় দিয়ে আবার রুমে পাঠিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, এরপর আমার উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতনকারীদের মধ্যে আছে সাকিবুল সুজন (শাখা ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক এবং ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের সংগীত বিভাগের ছাত্র), ইউসুফ তুহিন, মাজেদুর রহমান, শাহনেওয়াজ বাবু এবং আহমেদ ফয়সাল (শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি)। আমাকে প্রায় ঘণ্টাখানেক মারে। এর মাঝে ছাত্রলীগেরই হাছান সাইদী ভাই আমাকে সাহায্য করেছিল। উনি গোপনে সাংবাদিক সমিতির বন্ধুদের কল করেছিল। হাসান আলী, আনিস ভাই, সাদি ভাই, মাহি ভাই এবং তাওসিফ ভাইসহ সাত আটজন রাতেই চলে আসে। উনারা আসার পর ছাত্রলীগের ওরা মারধরের কথা অস্বীকার করে।