যে কোনো প্রয়োজনে, যে কোনো সংকটে মুমিন আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করবেÑ এটাই তো স্বাভাবিক। নিজের প্রয়োজনে মানুষ যেমন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তেমনি অন্যের প্রয়োজন পূরণের জন্যও দুআ করে। এ দুআ করাটাও ভ্রাতৃত্বের পরিচায়ক। ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় এ দুআ করার পুরস্কার বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে নবীজী (সা.)-এর পবিত্র বাণীতেÑ “যে তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দুআ করে, তার জন্য নিয়োজিত ফেরেশতা তখন ‘আমীন’ বলে এবং এও বলে, তোমার জন্যেও এ দুআ কবুল হোক।” (সহিহ মুসলিম-২৭৩২)
এই তো ভ্রাতৃত্বের পরিচয়। বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবে, সুখে-দুঃখে কাছে থাকবে, অন্যায় করলে কিংবা ভুল পথে চললে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনবে, তার প্রয়োজন পূরণের জন্যে আল্লাহর কাছে দুআ করবে। ঈমানী ভ্রাতৃত্বের এই দাবিগুলো যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, তাহলে আর বলে দিতে হয় নাÑ একজন মুমিনের সঙ্গে আরেকজন মুমিন কোন ধরনের আচরণ করতে পারে না। তবুও রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধন যেন ছিন্ন হয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেনÑ ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন। যে একজন মুসলমানের কোনো সংকট সমাধান করে দেয়, এর বিনিময়ে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার একটি সংকটের সমাধান করে দেবেন। যে একজন মুসলমানের দোষ লুকিয়ে রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ লুকিয়ে রাখবেন।’ (সহিহ মুসলিম- ২৫৮০)
আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনÑ ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, একে অন্যকে ধোঁকা দিয়ো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থেকো না, একজনের বিক্রির সময় আরেকজন আগে বেড়ে বিক্রি করতে যেয়ো না, বরং সকলেই আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও, ভাই ভাই হয়ে যাও।’
মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তাকে জুলুম করতে পারে না, তাকে লাঞ্ছিত করতে পারে না, তাকে তাচ্ছিল্য করতে পারে না। তাকওয়া তো এখানেÑ ‘নিজ বুকের দিকে ইশারা করে তিনি তিনবার এ কথা বলেন। এরপর বলেন, একজন মানুষের অন্যায় হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় ও তাচ্ছিল্য করবে। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই অপর মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান হারাম!’ (সহিহ মুসলিম-২৫৬৪)
এই হলো হাদিসের নির্দেশনা। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখব, রাসূলুল্লাহ (সা.) এ হাদিস দুটিতে যেসব কাজ থেকে আমাদের বারণ করেছেন, সেগুলোর প্রতিটিই এমন, যা ভ্রাতৃত্ব ও হৃদ্যতার পরিবেশ নষ্ট করে। সবশেষে তিনি বলে দিয়েছেন, একজন মুসলমানের প্রাণ হরণ করা যেমন হারাম, সম্পদ হরণ করা যেমন হারাম, তার সম্মান হরণ করাও হারাম।
এতো সতর্কবাণী ও নির্দেশনার পরও যদি দুইজন মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক স্বাভাবিক সম্পর্ক না থাকে, একজনের সঙ্গে আরেকজন কথা না বলে, তাহলে তাদের জন্য উচ্চারিত হয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি! নবীজী (সা.) বলেছেনÑ ‘প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার মানুষের আমল (আল্লাহর দরবারে) উপস্থিত করা হয়। সেদিন আল্লাহ তাআলা এমন সবাইকেই ক্ষমা করে দেন, যে তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না। তবে তাকে ছাড়া, যার এবং তার ভাইয়ের মাঝে বিদ্বেষ থাকে। তখন বলা হয়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা পরস্পর মিলে যায়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা মিলে যায়।’ (সহিহ মুসলিম-২৫৬৫)
বোঝাই যাচ্ছে, বিষয়টি সহজ নয়। যেদিন আল্লাহ রাহমানুর রাহীমের পক্ষ থেকে সব মুসলমানকে ক্ষমা করা হয়, সেদিনও পারস্পরিক বিদ্বেষপোষণকারী দুই মুমিনকে ক্ষমা করা হয় না! যেভাবেই হোক, দুইজন মুমিন যখন এমন অন্যায়ে জড়িয়ে পড়ে, তাদের ভ্রাতৃত্ববোধ যখন হারিয়ে যায়, যখন তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দেয়, একে অন্যের ক্ষতি কামনা করে, এমন পরিস্থিতিতে তাদের দুইজনকে মিলিয়ে দেয়াটাও বড় সওয়াবের কাজ।
হাদিসের বাণী লক্ষ্য করুনÑ ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করেছেন, আমি কি তোমাদেরকে নামায রোযা আর সদকার চেয়েও উত্তম কোনো কিছুর কথা বলব? তারা বললেন, অবশ্যই বলুন।’ তিনি বললেনÑ ‘পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দেয়া। আর পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়া তো (দ্বীনকে) মু-িয়ে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৯২১)
শেষ কথা, যে ঈমানকে বুকে ধারণ করে আমরা নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে পরিচিত করছি, সেই ঈমানের দাবিকে পূর্ণ করতে হলে আমাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুসংহত করতে হবে, কোথাও বিপরীত কিছু দেখা গেলে তা দূর করে পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হতে হবে। শান্তির সমাজ পেতে চাইলে এই ভ্রাতৃত্বের বিকল্প নেই।