তিস্তা নিউজ ডেস্ক ঃ ছাত্রদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি গতি পাচ্ছে না। যদিও দলটির বয়স মাত্র আড়াই মাস। এ সময়ের মধ্যে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত দলের মতো তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শী হওয়ার কথা নয়। তবুও দলটি নিয়ে অনেকেরই ছিল প্রত্যাশা।
দলটির যেভাবে আত্মপ্রকাশ এবং বর্তমান যে তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা নিয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করছেন। নেতৃত্বের মধ্যে টানাপোড়েন ও সমন্বয়হীনতার কারণে রাজনীতিতে তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, এটা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে। জনগণের সামনে এনসিপির বক্তব্য কী, তাও এতদিন স্পষ্ট ছিল না। তবে গত সোমবার নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর দলটির প্রধান নাহিদ ইসলামের পক্ষ থেকে সাতটি বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরা হয়। সামনে আরো অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
টানা সাড়ে ১৫ বছরের শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটানো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের সমন্বয়ে গঠন করা হয় এনসিপি। বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতির মাঠে নামা দলটির ২১৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। চলতি মাসে বেশকিছু উইং, সেল ও একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়েছে। আরো কিছু গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এনসিপির নেতারা বলছেন, সব কমিটির প্রায় সব নেতার বয়সই ৩০ বছরের কাছাকাছি। ফলে দলটির ভেতরে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের সংঘাত। নানা মত ও পথ এবং বিভিন্ন মতাদর্শ থেকে আসা তরুণদের নিয়ে গঠিত মধ্যপন্থার সেই দল এনসিপিতে স্পষ্ট হচ্ছে আদর্শগত বিভাজনও। এ ছাড়া দলটিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও হচ্ছে বিলম্ব। শীর্ষ নেতাদের ছাড়া বড় বড় পদে আসীনদের সেভাবে ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত দলটি জেলা-উপজেলায় কমিটি দিতে না পারলেও তারা সবাই ঢাকার বড় নেতা। সাংগঠনিক কাজে ধীরগতি দেখা গেলেও সামাজিকমাধ্যমে তারা সরব। ফলে এনসিপির মধ্যকার টানাপোড়েন এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এনসিপির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দলটি এগোচ্ছে। এনসিপিতে নির্বাচনি জোট গঠনের আলোচনাও রয়েছে। দলটির নেতৃত্বে সমমনা দলগুলো নিয়ে জোট গড়া হবে নাকি বড় দুই দলের কারো সঙ্গে জোট গঠন করবে, তা নিয়েও শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এতে নেতৃত্বের সংঘাতও ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে দলীয় একাধিক সূত্র।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম আমার দেশকে বলেন, এনসিপি নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয় নেই। তবে আরো ভালোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে আমরা কিছুটা সময় নিচ্ছি। এটা নতুন একটি দল। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই পরস্পরের কাছাকাছি এসেছি। তাই আড়াই মাসের একটি দলের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর মতো আচরণ আশা করাও ঠিক হবে না। তারপরও এনসিপি যথেষ্ট বিচক্ষণতা (ম্যাচিউরিটি) ও সমন্বয় করেই কাজ করার চেষ্টা করছে। আমরা যে সমন্বয়হীনতার কথা বলছি, সেটা সময়ের সঙ্গে কেটে যাবে।
দৃশ্যমান সাংগঠনিক অগ্রগতি নেই
কোটা পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন গত বছরের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঐতিহাসিক ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ছাত্ররা। সংগঠনটি জেলা, মহানগর ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ’খানেক কমিটি গঠন করে। অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংগঠিত করতে গঠিত হয় জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত কয়েক মাসে দেশের অন্তত ৪৫০ থানায় প্রতিনিধি কমিটি গঠন করে সংগঠনটি। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে প্রায় সমানসংখ্যক নেতা যুক্ত হন দলটিতে। সংগঠন দুটির কার্যক্রম কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
সূত্রমতে, জেলা-উপজেলাসহ তৃণমূলের কমিটিগুলো এনসিপির কমিটিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হলেও গত আড়াই মাসে তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে এনসিপির মহানগর, জেলা ও উপজেলা কমিটি ১৫ মের দিকে দেওয়ার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের কারণে পিছিয়ে যায়। আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যে অনেক কমিটি ঘোষণা করা হবে। এজন্য কয়েকটি মহানগর, অনেক জেলা ও উপজেলার প্রস্তাবিত কমিটি প্রস্তুত রয়েছে।
এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা খুব দ্রুতই তৃণমূলে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে তৃণমূলে আমাদের প্রাথমিক কার্যক্রম আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির ব্যানারে। ফলে তৃণমূলে আমাদের একটি প্রাথমিক ভিত্তি রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের জন্যও ঈদুল আজহার আগে বড় ধরনের একটি কমিটি প্রস্তুত করতে হবে। সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
দল সম্পর্কে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন আমার দেশকে বলেন, সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য আমরা গোটা দেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেছি। আমাদের সংগঠক ও সদস্যরা কাজ করছেন। তৃণমূলের সংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। আন্দোলন-সংগ্রামসহ নানা বাস্তবতার কারণে আমরা তৃণমূলে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে পারিনি। তবে আমরা আশাবাদী, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের সংগঠক ও সদস্যরা সারা দেশে তৃণমূলের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে কমিটি ফরমেশনের দিকে অগ্রসর হবেন।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, একটি রাজনৈতিক দলে বিভিন্নজনের বিভিন্ন কাজ অ্যাসাইন করা থাকে, তারা সে কাজগুলো করেন। এনসিপিতে চেইন অব কমান্ড রয়েছে, এটা কোনো ইস্যু নয়। তৃণমূলের কমিটি আমরা চলতি মাসের মধ্যে করে ফেলতে পারব। দলের নিবন্ধনের বিষয় আছে, এক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো চলতি মাসের মধ্যেই করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বড় নেতা অনেক, কাজ কম
এনসিপির ২১৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটি চারটি স্তরে বিন্যস্ত রয়েছে। এর মধ্যে দলটির আহবায়কের নেতৃত্বে দুজন সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ও ১৬ জন যুগ্ম আহবায়ক রয়েছেন। এই স্তরের নেতারা দলের বহিঃরাজনীতি দেখভাল করেন। সদস্য সচিবের নেতৃত্বে দুজন সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ও ৩৩ জন রয়েছেন যুগ্ম সদস্য সচিব পদে। তারা দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দেখে থাকেন। উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠকের নেতৃত্বে ৯ জন যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও ১৮ জন সংগঠক রয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠকের নেতৃত্বে ৭ জন যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও ২৪ জন সংগঠক রয়েছেন। এই দুই স্তরের নেতাদের কাজ জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন এবং তৃণমূলের রাজনীতি দেখভালের। মুখ্য সমন্বয়কের নেতৃত্বে একজন সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও ২৪ জন যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক রয়েছেন। তাদের কাজ দলের বিভিন্ন উইং ও সেল গঠন এবং সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। এ ছাড়া ৫৯ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন। এসব নেতার মধ্যে চার স্তরের শীর্ষ নেতাসহ হাতেগোনা কিছু নেতার বিভিন্ন কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানে সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে অপরিচিতদের রাজনৈতিকভাবে সেভাবে দেখা না গেলেও সামাজিকমাধ্যমে সরব থাকতে দেখা যাচ্ছে।
সূত্রঃ দৈনিক আমারদেশ।