Saturday, January 25, 2025

হাদিসের ভাষ্যে মিরাজের ঘটনা

 

শায়খ মুহাম্মদ ত্বহা হুসাইন ঃ ইসরা ও মিরাজ নবীজীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর অন্যতম। নবীজির রিসালাতের অনেক বড় মুজিযা। উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এক বড় সম্মাননা। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা যেমন প্রিয়নবী (সা.)-এর সম্মান আরও বৃদ্ধি করেছেন, তেমনি তাঁর উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করেছেন সৃষ্টিজগৎকে।

নবীজির (সা.) মদিনার হিজরতের আগের কথা। বাধা আর সফলতার মাঝে এগিয়ে চলছিল ইসলামের অগ্রযাত্রা। কাফির-মুশরিকদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ আর অকথ্য নির্যাতনে শানিত হচ্ছিল সাহাবিদের ঈমান। জ্বলে উঠছিল মুসলমানের দ্বীনি জযবা। এমনি সময়ে কোনো এক রাতে নবীজি (সা.) সাহাবিদের নিয়ে ইশার নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর কাবাসংলগ্ন ‘হাতিমে’ শুয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। নবীজি সেখানে তন্দ্রাবিষ্ট ছিলেন; নিদ্রা তখনো আসেনি। জিবরিল (আ.) নেমে এলেন। নবীজিকে জাগ্রত করলেন। অতঃপর তাঁকে নিয়ে গেলেন জমজমের কাছে। তাঁর বক্ষের অগ্রভাগ থেকে চুল পর্যন্ত বিদীর্ণ করা হলো। বের করা হলো তাঁর হৃৎপিণ্ড। তা আবে জমজম দ্বারা শোধন করা হলো। ঈমান ও প্রজ্ঞায় ভরপুর স্বর্ণের একটি পেয়ালা এনে তা দিয়ে ভরে দেওয়া হলো নবীজির বক্ষ মুবারক। অতঃপর হৃৎপিণ্ড যথাস্থানে রেখে দিয়ে উপরিভাগ সেলাই করে দেওয়া হলো। আনাস (রা.) বলেন, আমি এর চিহ্ন নবীজির বুকে প্রত্যক্ষ করেছি।

‘বুরাক’ নামক ক্ষিপ্রগতির একটি সওয়ারি আনা হলো, যা ছিল গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চরের চেয়ে ছোট ও দীর্ঘদেহী। রং ছিল শুভ্র। এমনই ক্ষিপ্র ছিল তার চলার গতি যে দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে পড়ত তার পায়ের খুর। তার পিঠের ওপর জিন আঁটা ছিল, মুখে ছিল লাগাম। নবীজি রেকাবে পা রাখবেন এমন সময় ‘বুরাক’ ঔদ্ধত্য দেখাল। জিবরিল তাকে থামিয়ে বললেন, হে বুরাক! তুমি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সামনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছ? তুমি কি জান, আল্লাহর কাছে তাঁর চেয়ে মহান ও প্রিয়তম কোনো ব্যক্তি কখনো তোমার ওপর সওয়ার হয়নি। এ কথা শুনতেই বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। (তিরমিজি : ৩১৩১)

অতঃপর নবীজি বুরাকে আরোহণ করলেন। মুহূর্তেই এসে উপস্থিত হলেন ফিলিস্তিনের বায়তুল মাকদিসে। জিবরিল একটি পাথর ছিদ্র করে বুরাককে বেঁধে রাখলেন। এটা সেই বৃত্ত, যেখানে নবীরাও নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। বায়তুল মাকদিসে ঢুকে তিনি দেখেন, মুসা (আ.) নামাজরত। তিনি ছিলেন ছিপছিপে ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী। তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো, যা ছিল কান পর্যন্ত ঝুলন্ত। দেখে মনে হবে যেন ‘শানওয়া’ গোত্রেরই একজন লোক। ঈসা (আ.)-কেও দণ্ডায়মান হয়ে নামাজ পড়তে দেখা গেল। তিনি ছিলেন মাঝারি গড়নের, সাদা ও লাল রং বিশিষ্ট। তাঁর চুল ছিল সোজা ও চাকচিক্যময়। তাঁর আকার-আকৃতি সাহাবি উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফি (রা.)-এর সঙ্গে অধিক মেলে। ইব্রাহিম (আ.)-কেও নামাজরত অবস্থায় দৃষ্টিগোচর হলো। নবীজি বলেন, তাঁর দেহাবয়ব আমার সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। (মুসলিম : ১৬৭)। এরই মধ্যে জামাত প্রস্তুত হলো। তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। সব নবী-রাসুল নবীজির পেছনে ইক্তেদা করলেন। ওখান থেকে বের হয়েই দেখলেন, জিবরিল (আ.)-এর হাতে দুটি সুদৃশ্য পাত্র; একটি শরাবের, অপরটি দুধের। পাত্র দুটি পেশ করা হলে নবীজি দুধেরটিকেই বেছে নিলেন। জিবরিল তাঁকে বললেন, আপনি ও আপনার উম্মত স্বভাবজাত বিষয়ই বেছে নিয়েছেন। আপনি যদি শরাব পছন্দ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। (মুসলিম : ১৬৮)।

এরপর শুরু হলো ঊর্ধ্বজগতের সফর। নবী (সা.) বুরাকের ওপরই ছিলেন। একে একে প্রতি আকাশের দ্বার তাঁর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। প্রথমে দুনিয়ার দৃশ্যমান আসমানে এসে জিবরিল (আ.) দ্বার উন্মুক্ত করতে অনুরোধ করেন। অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন হয়, কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিবরিল।

প্রশ্ন করা হয়, কে আছেন আপনার সঙ্গে? বললেন, মুহাম্মাদ। প্রশ্ন হয়, আপনি কি তার কাছে প্রেরিত হয়েছেন? বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর প্রথম আসমানের দ্বার খুলে দেওয়া হয়। তাঁরা এর ওপরে উঠে আসেন। নবীজি বলেন, ওখানে এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার ডানদিকে রুহের একটি ঝাঁক দেখা গেল, বাঁদিকেও তেমনি একটি ঝাঁক।


ওই ব্যক্তি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বাঁদিকে তাকালে ক্রন্দন করেন। তিনি আমাকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন, মারহাবা হে মহান পুত্র! মারহাবা হে মহান নবী! নবীজি জিবরিলকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কে? তিনি বললেন, তিনি আদম (আ.)। তাঁর ডান ও বাঁদিকে যাদের দেখলেন তারা তাঁর বংশধর। ডানদিকে যারা তারা জান্নাতি; আর বাঁদিকে যারা, তারা দোজখি। আর তাই তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বাঁদিকে তাকিয়ে কাঁদেন। (বুখারি : ৩৪৯)।

এরপর জিবরিল (আ.) নবীজিকে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশের উদ্দেশে ছুটলেন। সেখানেও দ্বার উন্মুক্ত করতে বলা হলে জিজ্ঞাসা করা হলো, কে? তিনি জবাব দিলেন, জিবরিল। প্রশ্ন করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মাদ। আবার প্রশ্ন হলো, তিনি কি আহূত হয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাঁকে আনার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি। দ্বার উন্মুক্ত করা হলে সেখানে দুই খালাতো ভাই, অর্থাৎ ঈসা ও ইয়াহইয়া ইবনে জাকারিয়া (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তারা উভয়ই নবীজিকে মারহাবা বলে দুআ করলেন। এরপর জিবরিল তাঁকে তৃতীয় আকাশে নিয়ে গিয়ে আগের মতো প্রশ্নোত্তর পর্বের পর দ্বার উন্মুক্ত হলে সেখানে ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে মুলাকাত হলো। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে গোটা রূপসৌন্দর্যের অর্ধেকটাই দান করেছিলেন। তিনিও নবীজিকে মারহাবা বলে উষ্ণ অভিবাদন জ্ঞাপন করলেন। একই পদ্ধতিতে চতুর্থ আকাশে পৌঁছালে সেখানে ইদরিস (আ.)-এর সঙ্গেও শুভেচ্ছা বিনিময় হল। নবীজি বলেন, আমরা যখন সেখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন মুসা (আ.) ক্রন্দন করতে লাগলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এই যুবক আমার পরে প্রেরিত হয়েছে। তদুপরি তাঁর উম্মত আমার উম্মতের চেয়েও অনেক বেশি জান্নাতে যাবে। একথা ভেবেই আমি কাঁদছি। সেখান থেকে নবীজিকে সপ্তম আকাশে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তিনি ইব্রাহিম (আ.)-কে দেখলেন, তিনি বায়তুল মা’মুরে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট। বায়তুল মা’মুর সেই স্থান, যেখানে রোজ এমন ৭০ হাজার ফেরেশতা ইবাদত করার জন্য প্রবেশ করেন, যাদের পালা এরপর আর কখনো আসে না।

ইব্রাহিম (আ.)-ও নবীজিকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন। অতঃপর নবী কারীম (সা.)-কে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো। পৃথিবী থেকে যেসব বস্তু অথবা রুহ ওপরে আরোহণ করে, সেগুলো এখানে পৌঁছে থেমে যায়। তদ্রূপ ঊর্ধ্বজগৎ থেকে নিম্নে আগমনকারী সবকিছু এখানে এসে থেমে যায়। নবীজি বলেন, সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে এত ঊর্ধ্বে পৌঁছে যাই, যেখান থেকে আমি আল্লাহর হুকুম-আহকাম লিপিবদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত ফেরেশতাদের ‘কলমের’ আওয়াজ শুনতে পেলাম।

অতঃপর আল্লাহ নবীজিকে যা দেওয়ার ছিল তা দিলেন। তিনি দিনরাত্রিতে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করলেন। ফিরে আসতে মূসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার রব আপনার উম্মতের উপর কী ফরজ করেছেন? নবীজি বললেন, ৫০ ওয়াক্ত নামাজ। তিনি বললেন, আপনি মহান রবের কাছে ফিরে যান এবং আরও হ্রাস করার আবেদন করুন। এতটুকু পালনের সাধ্য আপনার উম্মতের নেই। আমি তো বনি ইসরাঈলকে এর চেয়ে অনেক কম ফরজ দিয়ে খুব পরীক্ষা করে দেখেছি।... নবীজি বললেন, আমি এমনিভাবে বারবার আপন রব ও মূসা (আ.)-এর কাছে আসা-যাওয়া করতে থাকলাম। আর প্রতিবারই পাঁচ-পাঁচ করে কমতে থাকল। অবশেষে আল্লাহ পাক ইরশাদ করলেন, মুহাম্মাদ! দিবা-রাত্রির মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মাত্র। প্রত্যেক নামাজের জন্য ১০ নামাজের সওয়াব, ফলে সেই ৫০ নামাজই হয়ে যাবে। এ ছিল উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য মিরাজের পুরস্কার।

শেয়ার করুন