সৈয়দ আবদাল আহমদ ঃ প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ সরকারি অনেক দপ্তর ও সংস্থায় এখনো রাজত্ব করছেন পতিত শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে হাসিনার নিয়োগকৃত অধিকাংশ কর্মকর্তাই রয়ে গেছেন। তারা জোটবদ্ধ এবং নিজেদের মধ্যে কিছুদিন পরপর গোপন বৈঠকও করেন, যেন তারা সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। এ অবস্থায় সচিবালয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে সহসাই ‘আমলা বিদ্রোহ’ এবং নির্বাচন বানচালের আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অনুসারী আমলারা ‘জনতার মঞ্চ’ নাম দিয়ে আন্দোলন করেন এবং একপর্যায়ে সচিবালয়ে ‘আমলা বিদ্রোহ’ হয়। তারই পুনরাবৃত্তির আলামত দেখা যাচ্ছে পতিত সরকারের সুবিধাভোগীদের মধ্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিভিল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বর্তমানে এমন ৪৬ জন সচিব ও অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন, যারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের কট্টর সমর্থক। এদের কেউ কেউ আওয়ামী পরিবারের সন্তান, জামাতা কিংবা আত্মীয়স্বজন। একই সঙ্গে এরা দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক ও চরম সুবিধাভোগী এমন ১১ জন সচিব আছেন, যারা ওএসডি হিসেবে চাকরিতে বহাল আছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত এসব সচিব বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। এরা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন দায়িত্বে ফিরে আসার চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের অনেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন।
প্রশাসনে তাদের অতীত কর্মকাণ্ড দলদাস প্রকৃতির। আওয়ামী লীগের এজেন্ডার বাইরে কিছুই তারা বুঝতেন না। এদের অবিলম্বে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো না হলে এরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বশীভূত করে চোরাই পথে আবার ফিরে আসতে পারে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটের কারিগর আমলাদের অবসরে পাঠানো হয়েছে কিন্তু ২০২৪-এর ভোটের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা এখনো বহাল আছেন। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে ২০২৬-এর নির্বাচন পরিচালনা করা সহজ হবে না। কারণ তারা সচিবালয়সহ অন্যান্য সরকারি দপ্তরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। তার কিছু কিছু আলামত দৃশ্যমান হচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী এক বছরে উচ্চপদে নিয়োগ ও পদোন্নতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পদলেহী ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তারাই সচিব পদে বেশি পদোন্নতি পেয়েছেন। হাসিনা সমর্থক সচিবদের অপসারণের জন্য ‘জুলাই ঐক্য’, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এবং ‘বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা ঐক্য’সহ বিভিন্ন সংগঠন দাবি জানালেও এরা বহালতবিয়তে দায়িত্বে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারের অন্তত চারজন উপদেষ্টা আছেন, যারা তাদের প্রটেকশন দিয়ে যাচ্ছেন।
সচিবালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে শেখ হাসিনা থাকাকালে যেসব কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হন, বর্তমান সরকারের আমলে তাদেরই পদোন্নতি দিয়ে সচিব করা হয়েছে। এরা ফ্যাসিস্টদের সহযোগী ছিলেন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছেন। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে যারা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন এবং ১৭ বছর বঞ্চিত এবং নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের পরবর্তী পদোন্নতি অর্থাৎ সচিব পদে পদায়ন কিংবা পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। অজুহাত দেখানো হচ্ছে, এদের অভিজ্ঞতা কম। এদের মধ্যে অতি সামান্যসংখ্যক কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ এরা পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে সচিবালয়ে পরিচিত।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব, অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি এবিএম আবদুস সাত্তার শুক্রবার বিয়াম মিলনায়তনে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত একটি সেমিনারে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের উপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ব্যাচমেট ও বন্ধু মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব ফোন করলে ফোন ধরেন না। তারা ফ্যাসিস্ট আমলের অপকর্মের হোতা আমলাদের অপসারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বিগত ১৭ বছরের বঞ্চিত ও নির্যাতিত কর্মকর্তাদের যথোপযুক্ত পদায়ন এবং পদোন্নতির উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এটা দুঃখজনক। তিনি অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার দুনীতির প্রমাণ তার কাছে রয়েছে। এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না।
সাবেক সচিব এএফএম সোলাইমান চৌধুরী বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট অনুসারী আমলারা খুবই ভয়ংকর। এরা এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন। এদের চরিত্র ও অভ্যাস পাল্টায়নি। এরা দুর্নীতিপরায়ণ এবং সুযোগ বুঝে এখনো দুর্নীতি করছেন। এরা কোন সময় যে কী করে বসেন, তা বলা মুশকিল। তাই চিহ্নিত এ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অবসরপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন সচিব দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এইচটি ইমাম ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রশাসন আওয়ামীকরণের যে সংস্কৃতি তৈরি করে গেছেন, বিগত শেখ হাসিনার আমলে তা আরো ব্যাপকতা লাভ করে। সচিবালয় যে দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র, সে বিষয়টিই মানুষ ভুলে যায়। সচিবালয় অনেকটা দলীয় কার্যালয়ের মতো হয়ে পড়েছিল।
সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ।